নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লিগুলোয় শ্রমিকদের ব্যস্ততা বেড়েছে। পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে তাঁতের শাড়ি ও লুঙ্গির জমজমাট ব্যবসা হয়। তবে রং, সুতা, কেমিক্যাল ও বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বাড়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁত মালিকদের।
তাঁত সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জ। জেলার বেলকুচি, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, চৌহালী, এনায়েতপুর, ও সদরের একাংশ মিলে তিন লাখেরও বেশি ইঞ্জিন এবং হস্তচালিত তাঁত রয়েছে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ।
সরেজমিন দেখা গেছে, জেলার বিভিন্ন তাঁতপল্লিতে তৈরি হচ্ছে আধুনিক মানের জামদানি, সুতি জামদানি, সুতি কাতান, বেনারসি ও বিভিন্ন ধরনের লুঙ্গি। সেই সঙ্গে পাইকারি ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বেড়েছে।
এ অঞ্চলের তাঁতপল্লিগুলোয় তৈরি উন্নতমানের শাড়িসহ বিভিন্ন কাপড় দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। ঢাকার বড় বড় বুটিক হাউজগুলো তাদের পরিবেশকের মাধ্যমে ভারতের কলকাতা, শুভরাজ, গঙ্গারামপুর, দুবাই, যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁতের কাপড় বাজারজাত করছে।
এ সময় কয়েকজন তাঁত মালিক জানান, রং, সুতা, কেমিক্যাল ও কাঁচামালের দাম বাড়ায় তাঁতের শাড়ি ও লুঙ্গির উৎপাদন খরচ বেড়েছে। উৎপাদন খরচের সঙ্গে তুলনা করে বাজারজাত করতে পারছেন না। এ ছাড়া ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে তাঁত শ্রমিকদের কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
বেলকুচি এলাকার তাঁত মালিক রহমত আলী বলেন, ‘কয়েক বছর আগে করোনার কারণে আমাদের তাঁতশিল্প কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। গত বছর থেকে ব্যবসা মোটামুটি ভালো হচ্ছে। কিন্তু রং ও সুতার দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। সেজন্য বেশি লাভবান হতে পারছি না।’
একই এলাকার সাইফুল ইসলাম জানান, তার কারখানায় শ্রমিকরা দিন-রাত কাজ করছেন। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে অর্ডার আসছে। রং ও সুতার বাজার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে আবারও ঘুরে দাঁড়াবে জেলার ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প।
তাঁত শ্রমিক শরিফুল বলেন, ‘দীর্ঘদিন এ কাজের সঙ্গে যুক্ত আছি। রোজার সময় প্রতিদিন ভোর থেকে কাজ শুরু হয়, চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। আমাদের আয় নির্ভর করে উৎপাদনের ওপর, কাজ করলে মালিকরা টাকা দেন, না করলে দেন না। ঈদ ও বৈশাখ উপলক্ষে কাজের চাপ থাকলেও আগের মতোই মহাজনরা উৎপাদনের ওপর টাকা দেন। উৎসব উপলক্ষে আমরা কোনো বোনাস পাই না।’
অপর তাঁত শ্রমিক আলতাব বলেন, ‘বাজারে সবকিছুর দাম বেশি, রমজানে খরচ আরও বেশি হচ্ছে। তাই এ বছর বেশি পরিশ্রম করতে হচ্ছে। প্রতিদিন যে টাকা আয় হচ্ছে তা দিয়ে কোনোরকম পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে আছি।’
বেলকুচিতে শাড়ি কিনতে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী সুমন ব্যাপারী বলেন, ‘সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন তাঁতপল্লি থেকে তাঁতের শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা কিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, করটিয়া, বাবুরহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করে থাকি। এখানে ৫০০ টাকা শুরু করে কয়েক হাজার টাকা দামের শাড়ি পাওয়া যায়। বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা এখানে এসে শাড়ি ও লুঙ্গি কিনে নিয়ে যান।’
বেলকুচি উপজেলা হ্যান্ডলুম অ্যান্ড পাওয়ার লুম অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বৈদ্যনাথ রায় বলেন, ‘বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন অর্ডার আসছে। পাইকাররা এসে পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা যদি এগুলো নিয়ে বিক্রি করতে পারেন তাহলে এ ব্যবসার সফলতা আসবে। আর তারা যদি বিক্রি করতে না পারেন তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব।’
সিরাজগঞ্জ হ্যান্ডলুম এবং পাওয়ারলুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বদিউজ্জামান মন্ডল বলেন, ‘রোজার ঈদকে সামনে রেখে শাড়ি ও লুঙ্গি তৈরিতে ব্যস্ত তাঁতিরা। প্রতিনিয়তই রং, সুতাসহ তাঁতের উপকরণের দাম বাড়লেও কাপড়ের দাম না বাড়ায় এ শিল্পে রুগ্ণতা সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া এ বছর রোজার ঈদকে সামনে রেখে প্রায় হাজার কোটি টাকার কাপড় বেচাকেনার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বাজারে এখনো তেমন সাড়া পাচ্ছি না। তাই ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখতে রং, সুতা ও কাঁচামালের দাম কমাতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।’
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু ইউসুফ সূর্য্য বলেন, ‘তাঁতশিল্প সিরাজগঞ্জের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এ শিল্পের সঙ্গে অনেক মানুষ জড়িত রয়েছে। তাই শিল্পকে রক্ষা করতে রং, সুতাসহ বিভিন্ন কাঁচামালের দাম কমাতে হবে। তাঁতিদের কম সুদে ঋণ ও ভর্তুকি দিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই এ তাঁতশিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে।’
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব নুরুল হক নয়ন
✆ ০৯৬৩৮-৯০৭৬৩৬। ই মেইল: thedailydrishyapat@gmail.com
।
Copyright 2025 Pratidinerdrishyapat