আব্দুল খালেক মন্টু,লেখক – প্রাবন্ধিক:
নদীর ধারে আমাদের গ্রামের বাড়ি। নদীতে গোসল করে, সাতার কেটে, মাছ ধরে, নৌকায় চড়ে, নৌকা চালিয়ে কাটিয়েছি জীবনের অনেকটা সময়। তাই নদীর সঙ্গে গড়ে ওঠে গভীর মিতালী। নদীর সঙ্গে রয়েছে আমার পুরোনো প্রেম। যেখানেই যাই, সেখানেই সবার আগে খুঁজি নদী। কিন্তু কোথাও পাইনা নদীর সেই আগের রূপ-যৌবন।
নদী যেন এখন বুড়িগঙ্গার মতো জরাগ্রস্ত – হাড্ডিসার বুড়ি। ইতোমধ্যে অনেক নদী অস্তিত্ব হারিয়েছে – মারা গেছে। উত্তরাঞ্চের প্রকৃত রূপ থেকে হারিয়ে যাওয়া ৩ শতাধিক নদীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে – ধরলা, জলঢাকা, দুধকুমার, তিস্তা, স্বতী, ঘাঘট, নীলকুমার, বাঙালি, বড়াই, মানস, কুমলাই, লাতারা, ধুম, বুড়িঘোড়া, সোনাভরা, হলহলিয়া, লোহিত, ঘরঘরিয়া, ধরণি, নলেয়া, জিঞ্জিরাম, ফুলকুমার, কাটাখালী, সালমারা, রায়ঢাক, খারুভাজ, যমুনেশ্বরী, চিকলী, মরা, করতোয়া, ইছামতী, আলাইকুমারী, মরা তিস্তা, চন্দ্রকোনা, বহুলী, আত্রাই, ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা, নাগর, শিব, ফকিরনী, পুনর্ভবা ইত্যাতি। স্থানীয় প্রবীনেরা জানান – এসব নদী একসময় প্রচণ্ড – প্রমত্তা ছিল। ছিল লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার উৎস। এসব নদীর মধ্যে অনেক নদীর অস্থিত্বই এখন আর নেই। সম্ভবত এ কারণে গানের একটি কলি এরকম – ‘এখানে একটা নদী ছিল, জানলো না তো কেউ ‘। কিছু নদীতে এখনও কোনো কোনো জায়গায় তিন মাস পানি থাকে।
আবহাওয়া বা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে উত্তরাঞ্চের দেড় হাজার কিলোমিটার হারিয়ে যাওয়া জলপথ আর ফিরে পাওয়া যাবে না। ভারতের একতরফাভাবে নদীশাসন, খরামৌসমে তীব্র তাপপ্রবাহ, বর্ষায় দূকুল উপচে বন্যা, আবার শীত মৌসমে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, প্রয়োজনের তুলনায় বৃষ্টিপাত কম হওয়া, অপরিকল্পিত ভুগর্ভস্থ পানি উত্তোলনসহ নানা কারণে এ অঞ্চলের নদীগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। গত ৫০ বছরে ছোট বড় ৩ শতাধিক নদী ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে। সম্প্রতি কোনোরকমে বেঁচে থাকা শতাধিক নদী যৌবন হারিয়ে ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। সেসঙ্গে নদীগুলোর অনুচর খালবিল, দহডাঙ্গা, দাঁড়, হাওড়বাওড়, জলাভূমিগুলোরও এখন আর অস্থিত্ব নেই। ফলে এ অঞ্চলের কৃষি, মৎসসম্পদ, পাখী, জনস্বাস্থ্য, প্রাণী, উদ্ভিদ প্রভৃতি হুমকির মুখে পড়েছে। নদীতে পানি না থাকায় জমিতে সেচকাজ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
আবহমানকাল থেকে মাকড়াসার জালের মতো বেষ্টন করে ছিল শত শত নদী। ভাটিয়ালী, মারফতি, মুর্শিদী গান গেয়ে রংবেরঙের পালতোলা নৌকাগুলোর মাঝিরা নদীর প্রাণকে সজীব করে রেখেছিলেন। এসব নদীতে চলাচল করতো খ্যাপের নৌকা, লঞ্চ, গহনারনৌকা, বাইচের নৌকা, গুনটানা নৌকাসহ নানা রকমের নৌকা। কিন্তু এখন ঐসব শুধুই স্মৃতি।
লেখক – প্রাবন্ধিক।