মাসুদ রানা,সিনিয়র রিপোর্টারঃ
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন র্যাব-৩ বিভিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে রেলভ্রমন একটি নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হিসেবে সকলের নিকট সুপরিচিত। সাচ্ছন্দে যাতায়াতের জন্য ট্রেনের কোন বিকল্প নাই। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জনসাধারণের বড় একটি অংশ নিরাপদ যাত্রার মাধ্যম হিসেবে ট্রেনে ভ্রমণ করে থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু দুষ্কৃতিকারী ও টিকেট কালোবাজারি চক্রের দৌরাত্মে স্বস্তিকর রেলভ্রমনের টিকেট প্রাপ্তি অনেক সাধারণ জনগণের জন্য জন্য অস্বস্তি, চিন্তা ও ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনলাইনে বা রেল স্টেশনের টিকেট কাউন্টারে টিকেট পাওয়া না গেলেও কালোবাজারে অধিক মূল্যে টিকেট বিক্রি হতে দেখা যায়। টিকেট কালোবাজারিরা বিভিন্ন কৌশলে ট্রেনের টিকেট অগ্রিম সংগ্রহ করে অবৈধভাবে নিজেদের কাছে মজুদ করে রেখে সাধারণ যাত্রীদের নিকট দুই-তিন গুন বেশি দামে টিকেট বিক্রি করছে। সাধারণ যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী টিকেট না পাওয়া এবং টিকেট কালোবাজারী কর্তৃক অধিক মূল্যে টিকেট বিক্রয়ের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচিত হয়।
ইতিপূর্বে গত ২৫ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখ টিকেট কালোবাজারি চক্র উত্তম ও সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতাসহ ১৪ জন সক্রিয় সদস্যকে ১২শ এর অধিক ট্রেনের টিকেটসহ গ্রেফতার করেছে র্যাব। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃত ট্রেনের টিকেট কালোবাজির চক্রের সদস্যদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষন করে ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি প্রতিরোধ ও কালোবাজারিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে র্যাব-৩।
এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র্যাব-৩ এর আভিযানিক দল রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে দেশব্যপী ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি চক্র ঢালী সিন্ডিকেটের মূলহোতা মোঃ মিজান ঢালী (৪৮)তার প্রধান সহযোগী মোঃ সোহেল ঢালী (৩০)মোঃ সুমন (৩৯)মোঃ জাহাঙ্গীর আলম (৪৯)মোঃ শাহজালাল হোসেন (৪২)মোঃ রাসেল (২৪)মোঃ জয়নাল আবেদীন (৪৬)মোঃ সবুর হাওলাদার (৪০)নিউটন বিশ্বাস(৪২) গ্রেফতার করা হয়।
উদ্ধার করা হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ট্রেনের বিপুল পরিমাণ টিকেট, ৮টি মোবাইল ফোন, ১টি এনআইডি, ১টি ড্রাইভিং লাইসেন্স, কালোবাজির বিভিন্ন আলামত এবং টিকেট বিক্রয়ের নগদ ১১,৪২২/- টাকা।প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা ট্রেনের টিকেট কালোবাজারির সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
দুপুরে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গনমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের জানান, গ্রেফতারকৃতরা দেশব্যপী ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি ঢালী সিন্ডিকেটের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত মিজান এর নেতৃত্বে এই চক্রটি সংঘবদ্ধভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় সকল ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি করে আসছিল। গ্রেফতারকৃত মিজান দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকেট বুকিং এর জন্য চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে যুক্ত রয়েছে। ২০০৩ সালে সে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান ডেফোডিল এর কমলাপুর রেলস্টেশন শাখায় পিয়ন হিসেবে যোগ দেয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকেট বুকিং এ সিএনএস বিডি .এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হলে, অভিজ্ঞ কর্মী হিসেবে তাকে চাকুরিতে পুনঃবহাল রাখা হয়।
সর্বশেষ ২০২০ সালে রেলওয়ে টিকেট এর চুক্তি সহজ.কম কে দেয়া হলে সেখানেও গ্রেফতারকৃত মিজানের চাকুরি বহাল থাকে। দীর্ঘদিন টিকেট এর দায়িত্বপ্রাপ্ত চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান সমূহের সাথে যুক্ত থাকায় সারাদেশব্যাপী বিভিন্ন স্টেশনের সহজ.কম এর অফিসে এবং বড় বড় রেলওয়ে স্টেশনের কর্মচারীদের সাথে তার পরিচিতি বৃদ্ধি পায়। এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই সে বিভিন্ন স্টেশনে থাকা সহজ.কম এর সদস্য, টিকেট কাউন্টার ও অন্যান্য কালোবাজির চক্রের সদস্যদের সমন্বয়ে বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টিকেট বিক্রি করতো।
বিশেষ করে ঈদ, পূজা, সাপ্তাহিক ছুটিসহ বিশেষ ছুটির দিনকে উপলক্ষ করে গ্রেফতারকৃত মিজান ও সোহেল বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে সাধারণ সময়ের তুলনায় অধিক সংখ্যক টিকেট সংগ্রহ করতো। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত মিজান ও সোহেল প্রতিবছর ঈদ মৌসুমে দেশব্যাপী বিভিন্ন স্টেশনের সহজ.কম এর কর্মচারী ও টিকেট কাউন্টারম্যানদের মাধ্যমে আনুমানিক প্রায় ২-৩ হাজার রেলওয়ের টিকেট কালোবাজির মাধ্যমে বিক্রি করতো। তারা আসন্ন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরে পূর্বের চাইতেও অধিক সংখ্যক টিকেট সংগ্রহের জন্য পরিকল্পনা করছিল বলে জানা যায়।
টিকেট কালোবাজারীদের সম্পর্কে আরো জানতে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেঃকর্ণেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,গ্রেফতারকৃতরা টিকেট বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে ৫০ ভাগ সহজ.কম ও রেলওয়ে স্টেশনের টিকেট কাউন্টারম্যানরা পেতো এবং বাকি ৫০ ভাগ সিন্ডিকেটের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত মিজান, সোহেলসহ বাকি বিক্রয়কারী সহযোগীদের মাঝে ভাগাভাগি হতো। এই অর্থ কখনো তারা নগদ হাতে-হাতে বুঝিয়ে দিতো আবার কখনো মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে লেনদেন করতো বলে জানা যায়।
অধিনায়ক আরো বলেন, সিন্ডিকেটের প্রত্যেক সদস্য অবৈধভাবে ট্রেনের টিকেট বিক্রি করে প্রতি মাসে ২০/২৫ হাজার টাকা উপার্জন করতো বলে জানা যায়। এভাবেই পরষ্পরের যোগসাজশে চক্রটি দীর্ঘদিন যাবৎ দেশব্যাপী ট্রেনের টিকেট কালোবাজারি করে আসছিল।
গ্রেফতারকৃত সবুর সিন্ডিকেটের মূলহোতা গ্রেফতারকৃত মিজান এর সাথে ট্রেনের টিকেট কালোবাজির সাথে জড়িত বলে জানা যায়।গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।