নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি:
আজ বুধবার ১লা মে শ্রমিক দিবস। ঘড়ির কাটা দু’টার ঘরে। কাঠ ফাটা রোদ। বাহিরে বের হওয়া দু:স্কর। অথচ এই রোদ্রে ঝাড়ু হাতে দোকানের ভিতরে ও সামনে ময়লা পরিস্কার করছিল ৮-১০ বছরের কাইয়ুম নামের এক শিশু। নওগাঁ শহরের বরুনকান্দি ঠ্যাংভাঙ্গার মোড় নামক স্থানে দেখা মিলে তার। এই প্রতিবেদক কাছে গিয়ে জিঙ্গেস করতেই চটপটে উত্তর দু’শ টাকা দিনে এই দোকানে কাজ করে সে। আজ মে দিবস শুধু এটা জানে। কিন্তু দিবসটি কি? সেটা জানে না সে।
দুপুর আড়াইটার দিকে শহরের ঢাকা বাইপাস নামক স্থানের এক চালকলের চাতালে কয়েকজন নারী শ্রমিককে দেখা যায় এই দুপুরে কাজ করতে। কাজ শেষে একটু স্বস্তির আশায় ছাঁয়ায় গিয়ে বসলেন তারা। সকলেই শ্রমিক দিবসেও শ্রম দিচ্ছে টাকা রোজগারের আশায়।
এর আগে এদিন সকাল ১১টার দিকে জেলার বদলগাছী উপজেলায় যাওয়ার পথে রাস্তার কাজ করতে দেখা যায় কয়েকজন নারী-পুরুষকে। শ্রমিক দিবস সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় তাদের কাছে।
রবিউল ইসলাম নামের ফোরম্যান জানালেন, কাজ না করলে শ্রমিকরা খাবে কি? তারা বিভিন্ন জায়গায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের হয়ে সড়ক ও জনপথের কাজ করে। রবিউল জানালেন, অন্যান্য শ্রমিকদের শ্রমিক দিবস উপলক্ষে ছুটি নিতে বলেছিলাম। তারা ছুটি নেয়নি। কারণ কাজ না করলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দিনের মজুরি দিবেনা। তাই শ্রমিক দিবস জেনেও তাদের লাভ নেই। ঘরে চাল-ডাল না থাকলে, জেনে কি হবে? প্রশ্নের সুরে জানালেন তিনি। আর এভাবেই দিন দিন শ্রমিক দিবসের মর্যাদা, তাৎপর্য ও গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে।
তাই মে দিবসেও নওগাঁয় ফিলিং স্টেশন, বাস, ট্রাক, সিএনজি, অটোরিকসা, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন কাজের মধ্য দিয়ে। শ্রমিক দিবসেও শ্রম বিক্রি করছেন শ্রমিকরা।
১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ওই দিন অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েকজন শ্রমিককে জীবন দিতে হয়। এরপর থেকে আন্তার্জাতিকভাবে দিনটি ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
আর বাংলাদেশে শ্রমিকদের অধিকার ও দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মে দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে মহান মে দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। মে দিবস রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। এরপর থেকে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয় মে দিবস। এই দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য থাকে শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। যাতে করে তাঁরা মে দিবসের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারেন ও নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন(ন্যাম) শীর্ষ সম্মেলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে মেহনতি মানুষেরই জয়গান গেয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত, একদিকে শোষক, আর অন্যদিকে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ এই ভাষণ বিশ্বের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান দিয়েছিলো বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু জানতেন শোষিত নিপীড়িত মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে সমাজে সাম্যতা আসবে না।
কিন্তু শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে এ দিবস পালনের এত বছর পরও শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য মজুরির দাবি এখনো উপেক্ষিত, এখনো তাঁদের বিরাট অংশ মৌলিক মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত।
মে দিবসে সব সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ। তবুও কিছু মানুষ রুটিরুজির জন্য কাজে নেমেছেন। কারণ এক বেলা কাজ না করলে তাঁর পরিবারকে কাটাতে হবে অনাহারে। কারও কারও আবার মেলে না ছুটি। ছুটির দিনে কাজের জন্য জোটে না বাড়তি অর্থও। আট ঘণ্টা কাজের কথা থাকলেও কাজ করতে হচ্ছে আট ঘণ্টার অধিক। ওভারটাইম করতে আগ্রহী না থাকলেও বাধ্য হয়ে তা করতে হয়। সেই ওভারটাইমের টাকাও ঠিকমতো পাওয়া যায় না বা দিতে নানা ছলচাতুরী করে মালিকপক্ষ।
তারপরও তাদের কাজের নেই নিরাপত্তা, নেই ভবিষ্যৎ। এতেই বোঝা যাচ্ছে, আমাদের শ্রমিকদের অবস্থা কতটা শোচনীয়। মে দিবস যায়, মে দিবস আসে। কিন্তু তাঁদের ভাগ্য আর পরিবর্তন হয় না। ফলে পালনের জন্য মে দিবস পালন না হোক। এর মুখ্য উদ্দেশ্যই হোক শ্রমিকের অধিকার আদায় ও শ্রমিকের নিরাপত্তা।
বাংলাদেশে অসংখ্য শ্রমিক সংগঠন রয়েছে। শ্রমিকদের স্বার্থে তাদের আরও বেশি অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। শ্রমিকদের সব দাবি মালিকপক্ষ বা সরকারের কাছে তারা তুলে ধরতে পারে। তাতে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের দূরত্ব অনেকখানি লাঘব হবে। শ্রম আইনগুলো কঠোরতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সঙ্গে তৈরি করতে হবে শ্রমিকবান্ধব আইন, যা শ্রমিকদের স্বার্থে কথা বলবে। এর মাধ্যমে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের অর্থনীতি।
এলাকার নিলমনী, সুমন, তপনসহ কয়েকজন দিন মজুর বলেন, একদিন কাজ না করলে খাবার জুটবে না, তাই কোন দিন কি, জেনে কি লাভ হবে বলুন?
এদিকে শ্রমিকদের মধ্য শিশু ও নারী শ্রমিকই বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। শ্রমের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। বেকারি, ব্রিক ফিল্ড, মুদির দোকান, চায়ের দোকান, দিনমজুর, গৃহচারিকা, গ্যারেজ, ওয়ার্কশপ, গাড়ি চালক, ইট-ভাটা, বাস-ট্রাকের হেলফার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা ব্যবহার হচ্ছে। নারীরাও শ্রম দিচ্ছে মাটিকাটা, রাস্তা সংস্কারে, ইট-ভাটা ও বাড়ি নির্মাণসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টসাধ্য কাজে।
জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা সিএনজি-অটো শ্রমিক ইউনিয়রে সাধারণ সম্পাদক মো: ফারুক হোসেন মুঠোফোনে বলেন, দিবসটি আমরা পালন করেছি। সেখানে বিভিন্ন সচেতনতামূলক বক্তব্য রেখেছি। তারপরও বলবো এই শ্রমিক দিবস আন্তর্জাতিকভাবে এসেছে। যেখানে ব্যাংকারররা বা অন্যান্য অফিসের কর্মরতরা ৮ঘন্টার বেশি ডিউটি না করার জন্য আন্দোলন করেছিল। আমরাও সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন মালিক পক্ষের সাথে কথা বলে থাকি। অতিরিক্ত ডিউটি করে নিলে তাদের যেন নায্য মজুরি দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের শ্রমিকদের জন্য এই দিবস না। এই দিনটিতে বসে থাকবে এমন শ্রমিক আমাদের এখানে নেই। কারণ তাদের গাড়ি না চালালে সংসার চলবে কেমনে। তাই শুধু দিবস পালন করে তাদেরকে মনে করে দেওয়া হয় শ্রমিক দিবস সম্পর্কে। তারপরও আমরা দিনের শ্রমিকরা দিবসটির যথাযথ ইতিহাস জানার ও পালন করার চেষ্টা করি।