নওগাঁ প্রতিনিধি:
একেকটা নৌকায় একেক রকমের সাজানো। ঢাক-ঢোল আর সাউন্ড বক্স ও মাইকের সাউন্ডে মুখরিত চারেদিক। সনাতন ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন বয়সের ছেলে-মেয়ে, শিশু, কিশোর, কিশোরী, যুবক-যুবতীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের নাচানাচি। আর সেই দৃশ্য উপভোগ করতে নদীর দু’পারের ভিড় করেন হাজারো মানুষ। এমনই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ফুটে উঠেছে নওগাঁর রাণীনগরে লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে ছোট যমুনা নদীতে শত শত নৌকার নৌবহরে। এ পূজা উপলক্ষে শুক্রবার উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের কুজাইল বাজারে বসে গ্রামীণ মেলা। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ এ মেলা এখনো ধরে রেখেছে তার ঐতিহ্য।
লক্ষ্মী মানে শ্রী সুরুচি। লক্ষ্মীকে ধন সম্পদ আর সৌন্দর্যের দেবী বলে মনে করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তাই লক্ষ্মীপূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। শারদীয় দুর্গোৎসবের কয়েকদিন পর পূর্ণিমা তিথিতে লক্ষ্মীপূজার আরাধনা করা হয়। নারী-পুরুষ উভয়েই এ পূজায় অংশ গ্রহণ নেয়। বুধবার লক্ষ্মীপূজা শুরু হয়। এরপর শুক্রবার ছোট যমুনা নদীতে লক্ষ্মী প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে পূজার সমাপ্তি হয়।
স্থানীয়রা তাদের শত বছরের পুরনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে প্রতিমা বিসর্জনের দিন থেকে লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে কুজাইল বাজারে দুই দিনব্যাপী গ্রামীণ মেলার আয়োজন করে থাকেন। মেলায় বসে হরেক রকমের দোকানপাট। মেলার প্রথম দিন শুক্রবার মূল আর্কষণ নৌবহর। দ্বিতীয় দিন হয় বউ মেলা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার কাশিমপুর রাজবাড়ির রাজবাহাদুর শ্রী. অন্নদা প্রসন্ন লাহিড়ীর রাজত্ব পরিচালনার আগে থেকে লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রায় দুই’শ বছর থেকে লক্ষ্মী প্রতিমা বিসর্জনের দিন থেকে এ মেলা শুরু হয়। ঐতিহ্যবাহী এ মেলার বিশেষ আর্কষণ লক্ষ্মী প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে ছোট যমুনা নদীতে নৌবহর। এদিন দুপুরের পর থেকে রাণীনগর, আত্রাই, মান্দা, নওগাঁ সদরসহ কয়েকটি উপজেলার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নৌকায় চড়ে আসতে থাকে। পাশাপাশি মেলা ও নৌবহর উপভোগ করার জন্য নৌকায় ঘুরে বেড়ান অন্যান্য ধর্মের মানুষও। সাউন্ড বক্স, মাইক আর ঢাকের তালে তালে নৌকায় বিনোদনপ্রেমীদের নৃত্যে মুখরিত হয়ে উঠে ছোট যমুনা নদী। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মিলনমেলায় পরিণত হয় নদীর দু’পার। শুক্রবার প্রায় তিন শতাধিক নৌকা নদীতে নৌবহরে মেতে উঠে। চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এরপর নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।
কুজাইল হিন্দুপাড়া গ্রামের আশীষ কুমার বলেন, পূর্ব পুরুষেরা এ মেলা শুরু করে গিয়েছেন। আমরা শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছি। দুর্গাপূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব হলেও আমাদের এখানে লক্ষ্মীপূজার আনন্দটা বেশি হয়।
গৃহবধূ মুক্তা প্রামাণিক বলেন, প্রায় ৭ বছর থেকে নৌকায় চড়ে নৌবহর উপভোগ করেছি। এবার মেলায় গিয়ে সেটা উপভোগ করবো, তাই নৌকায় চড়িনি। মেলায় এসেছি কিছু খাব এবং কেনা কাটা করবো।
মিষ্টি দোকানদার সুশিল সরকার বলেন, এই মেলা উপলক্ষে একাধিক রকমের মিষ্টি ও জিলাপি বানিয়েছি। লোকজন মেলাতে ভালোই হয়েছে। আশা করছি মেলা ভালো হবে এবং আমাদের বিক্রিও ভালো হবে।
স্থানীয় মেম্বার ও মেলা কমিটির কোষাধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, শত শত বছরের এই মেলায় আমরা হিন্দু মুসলিম একে অপরকে সহযোগিতা করি। এই মেলায় অনেক দুর থেকে নৌকা নিয়ে এসে নৌবহরে যুক্ত হয়। যা হাজার হাজার নারী পুরুষ উপভোগ করে। এছাড়া এই মেলায় প্রায় দুই শত দোকান বসে যেখানে অর্ধকোটির বেশি বেচাকেনা হয়ে থাকে।
কুজাইল বাজার জাগরণ সংসদ ক্লাব ও মেলা কমিটির সভাপতি শাহিদুর রহমান বলেন, শত শত বছর আগে থেকে লক্ষ্মীপুজা উপলক্ষে এখানে মেলা হয়ে থাকে। এই মেলার মূল আকর্ষন নৌবহর। যা নদীর উভয় পাশে হাজার হাজার নারী পুরুষ উপভোগ করে। এরপর মেলায় জামাইদের বড় বড় মাছ, মিষ্টিসহ হরেক রকমের খাবার কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। এছাড়া পরের দিন বউমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আমরা হিন্দু মুসলিম উভয়ে মিলেমিশে এই আনন্দ উপভোগ করি। আমাদের এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকে। যা বলা যায় এক প্রকার সেতু বন্ধন।